নবজাতকের জন্ডিস একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যা যা জন্মের পর অনেক মা-বাবা লক্ষ্য করেন। এটি নবজাতকদের মধ্যে খুবই সাধারণ, বিশেষ করে জন্মের প্রথম সপ্তাহে। নবজাতকের ত্বক ও চোখের সাদা অংশ হলুদাভ হয়ে গেলে এটি জন্ডিসের লক্ষণ হতে পারে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি স্বাভাবিক এবং কিছুদিনের মধ্যে নিজে থেকেই সেরে যায়, তবে কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ যত্ন ও চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে অনেক মা দুশ্চিন্তায় পড়ে যান এবং বুঝতে পারেন না কী করা উচিত। তাই, এই ব্লগে আমরা নবজাতকের জন্ডিসের কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
পাশাপাশি, একজন মা হিসেবে কীভাবে শিশুর যত্ন নেবেন এবং কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন, সে সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেওয়া হবে।
জন্ডিস কী ?
জন্ডিস হল একটি শারীরিক অবস্থা, যেখানে শরীরে বিলিরুবিন নামক এক ধরনের পদার্থের পরিমাণ বেড়ে যায়, যার কারণে ত্বক ও চোখের সাদা অংশ হলুদ হয়ে যায়। এটি সাধারণত লিভারের কাজের সমস্যা বা অপ্রতুলতা থেকে ঘটে।
নবজাতকদের মধ্যে জন্ডিস একটি সাধারণ অবস্থা, বিশেষ করে জন্মের প্রথম সপ্তাহে, তবে এটি সাধারণত কোন গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি না করে নিজে থেকেই সেরে যায়।
জন্ডিস হতে পারে নানা কারণে, যেমন লিভারের অপরিপক্বতা, রক্তের গ্রন্থি থেকে বিলিরুবিনের অতিরিক্ত উৎপাদন, বা কিছু জিনগত সমস্যা। তবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে জন্ডিস স্বাভাবিক এবং সাময়িক, তবে কখনো কখনো চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।
নবজাতকের জন্ডিসের লক্ষণ
নবজাতকের জন্ডিস সাধারণত এক থেকে দুই দিনের মধ্যে শুরু হয় এবং এটি নবজাতকের শরীরে অতিরিক্ত বিলিরুবিন জমার ফলে ঘটে। বিলিরুবিন হল একটি পদার্থ যা পুরানো রক্তকণিকার ভাঙনের ফলে উৎপন্ন হয়।
নবজাতকের যেহেতু লিভার পুরোপুরি কার্যক্ষম না থাকে, তাই এটি বিলিরুবিন পর্যাপ্তভাবে ফিল্টার করতে পারে না, ফলে শরীরে জমে গিয়ে জন্ডিসের সৃষ্টি হয়। এর লক্ষণগুলো যথেষ্ট স্পষ্ট এবং বেশিরভাগ সময় খুবই সহজে শনাক্ত করা যায়।
এখানে নবজাতকের জন্ডিসের কিছু সাধারণ এবং গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ তুলে ধরা হলো:
লক্ষণ | বিবরণ |
ত্বকের হলুদাভ হওয়া | নবজাতকের ত্বক ও চোখের সাদা অংশ হলুদাভ হয়ে যায়। প্রথমে এটি মুখ এবং চোখের সাদা অংশে দেখা যায়, পরে শিশুর শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এটি সাধারণত বিলিরুবিনের আধিক্যের কারণে ঘটে। বিলিরুবিন একটি পদার্থ যা রক্তের পুরানো কণিকা ভেঙে তৈরি হয়, এবং যখন নবজাতকের লিভার পুরোপুরি কার্যক্ষম না থাকে, তখন এটি সঠিকভাবে ফিল্টার করতে পারে না। |
চোখের সাদা অংশে হলুদ ভাব | চোখের সাদা অংশের হলুদ ভাব সাধারণত জন্ডিসের সবচেয়ে স্পষ্ট লক্ষণ। শিশুর চোখের সাদা অংশে হলুদাভতা দেখা দিলে, এটি বিলিরুবিনের জমা হওয়া নির্দেশ করে। এটি প্রথম লক্ষণ হিসেবে প্রথম ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেখা দেয় এবং পরে শিশুর ত্বকেও ছড়িয়ে পড়ে। |
খাওয়ার সমস্যা বা অরুচি | জন্ডিসে আক্রান্ত অনেক নবজাতক খেতে অস্বস্তি বোধ করে বা খাবার খেতে চায় না। তাদের দুধ খাওয়ার পরিমাণ কমে যেতে পারে বা খাওয়ার প্রতি আগ্রহ হারাতে পারে। এটি শিশুর দুর্বলতা বা অসুস্থতার কারণে হতে পারে এবং শিশুর যথেষ্ট পুষ্টি গ্রহণের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। |
অস্বাভাবিক নিদ্রা | জন্ডিসের কারণে শিশুর নিদ্রা প্যাটার্ন পরিবর্তিত হতে পারে। অনেক শিশুই অতিরিক্ত ঘুমাতে থাকে, তাদের স্বাভাবিক ঘুমানোর সময়কাল বেড়ে যেতে পারে। এতে শিশু যথেষ্ট সময় ধরে খাওয়ার জন্য জাগ্রত হতে পারে না, যা তাকে দুর্বল বা আংশিক অসুস্থ মনে হতে পারে। শিশুর মাংসপেশীও দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। |
প্রতিরোধ ক্ষমতার দুর্বলতা | জন্ডিসের কারণে শিশুর শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যেতে পারে। এর ফলে শিশুর সহজে ঠান্ডা বা সর্দি-কাশি হতে পারে। এটি অন্যান্য সংক্রমণ বা শারীরিক অবস্থার প্রতি শিশুকে আরও সংবেদনশীল করে তোলে। |
অস্বাভাবিক শরীরের তাপমাত্রা | জন্ডিসের কারণে কিছু নবজাতকের শরীরের তাপমাত্রা কমে যেতে পারে। শিশুর ত্বক শীতল বা ঠান্ডা অনুভূত হতে পারে, বিশেষত যদি তার ত্বক অধিক হলুদ হয়ে যায়। তাপমাত্রার এই পরিবর্তন কখনও কখনও শারীরিক দুর্বলতার লক্ষণ হতে পারে। |
শিশুর অবস্থা দ্রুত খারাপ হওয়া | কিছু ক্ষেত্রে, যদি জন্ডিস গুরুতর হয়ে ওঠে, তবে শিশুর শারীরিক অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে পারে। ত্বক এবং চোখের সাদা অংশে অতিরিক্ত হলুদ ভাব দেখা দিতে পারে, শিশুর খাওয়ার পরিমাণ আরও কমে যেতে পারে এবং তার শক্তি বা সচেতনতা কমে যেতে পারে। এটি যদি দ্রুত চিকিৎসা না করা হয়, তবে শিশুর অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে। |
নবজাতকের জন্ডিসের কারণ
নবজাতকের জন্ডিস মূলত শরীরে অতিরিক্ত বিলিরুবিন জমার কারণে ঘটে। বিলিরুবিন হলো একটি পদার্থ যা রক্তের পুরানো রক্তকণিকার ভাঙনের ফলে উৎপন্ন হয়।
সাধারণত, নবজাতকের লিভার সম্পূর্ণভাবে কার্যক্ষম না থাকায় এটি বিলিরুবিনকে যথাযথভাবে ফিল্টার এবং প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করতে পারে না, যার ফলে বিলিরুবিন শরীরে জমে গিয়ে জন্ডিসের সৃষ্টি হয়।
নবজাতকের জন্ডিসের কিছু প্রধান কারণ নিম্নরূপ:
- ফিজিওলজিকাল জন্ডিস
নবজাতকের শারীরিক পরিস্হিতির কারণে এই ধরনের জন্ডিস হয়। জন্মের পর প্রথম কিছু দিন নবজাতকের লিভার পুরোপুরি কার্যক্ষম না থাকে, এবং শরীরে বিলিরুবিনের স্তর বৃদ্ধি পেতে পারে। এটি প্রায়শই প্রথম ৩-৫ দিনের মধ্যে দেখা যায় এবং সাধারণত কয়েক দিনের মধ্যে এটি সেরে যায়। এটি কোন গুরুতর সমস্যা নয় এবং সাধারণত চিকিৎসা ছাড়াই ঠিক হয়ে যায়।
- বিলিরুবিনের অধিক উৎপাদন
কিছু নবজাতক বিশেষভাবে বেশি রক্তকণিকা ভাঙার কারণে অতিরিক্ত বিলিরুবিন উৎপন্ন করে, যা শরীরের প্রক্রিয়ায় ফিল্টার হতে পারে না। এই অতিরিক্ত বিলিরুবিন শরীরে জমে গিয়ে জন্ডিসের সৃষ্টি করে।
- প্যাথোলজিকাল জন্ডিস
কিছু ক্ষেত্রে, জন্ডিসটি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে এবং নবজাতকের শরীরের অস্বাভাবিকতা বা রোগের কারণে হতে পারে। যেমন, জন্ডিসের ফলে নিউবর্নের লিভার বা রক্তের গ্রুপের অমিল, সংক্রমণ বা মায়ের দুধে কিছু উপাদান থাকতে পারে যা জন্ডিসের সৃষ্টি করতে পারে। যদি এই ধরনের জন্ডিস কয়েক দিনের মধ্যে সেরে না যায়, তবে চিকিৎসকের সহায়তা নিতে হবে।
- রক্তের গ্রুপের অমিল
যদি মায়ের এবং শিশুর রক্তের গ্রুপের মধ্যে অমিল থাকে (যেমন, মা Rh নেগেটিভ এবং শিশু Rh পজিটিভ), তবে শিশুদের জন্ডিস হতে পারে। এটি সাধারণত “হেমোলাইটিক ডিজিজ অফ দ্য নিউবর্ন” নামে পরিচিত। এই কারণে, নবজাতকের শরীরে অতিরিক্ত বিলিরুবিন তৈরি হয়।
- লিভার রোগ
কখনও কখনও, নবজাতকের লিভার যদি কোনো জন্মগত রোগ বা সংক্রমণের কারণে সঠিকভাবে কাজ না করে, তবে বিলিরুবিন ফিল্টার হওয়ার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় এবং তা শরীরে জমে গিয়ে জন্ডিস সৃষ্টি করতে পারে।
- প্রিম্যাচিউর শিশুর জন্ডিস
যদি কোনো শিশুর জন্ম সময়ের আগে (প্রিম্যাচিউর) হয়ে থাকে, তবে তার লিভার সঠিকভাবে কাজ করতে সক্ষম হয় না। এতে বিলিরুবিনের ফিল্টারিং ক্ষমতা কম থাকে এবং নবজাতক তাড়াতাড়ি জন্ডিসে আক্রান্ত হতে পারে।
- মায়ের দুধে সমস্যা
কিছু ক্ষেত্রে, মায়ের দুধে এমন কিছু উপাদান থাকে যা শিশুর জন্ডিস সৃষ্টি করতে পারে। এটি “ব্রেস্ট মিল্ক জন্ডিস” নামে পরিচিত এবং সাধারণত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে সমাধান করা যায়।
- সংক্রমণ বা মেডিক্যাল কন্ডিশন
নবজাতক যদি কোনো সংক্রমণ বা মেডিক্যাল কন্ডিশনে ভোগে (যেমন, রক্তবাহিত সংক্রমণ), তবে তা জন্ডিস সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া, গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টাইনাল সমস্যা, নিউমোনিয়া বা অন্যান্য রোগও জন্ডিসের কারণ হতে পারে।
নবজাতকের জন্ডিস হলে মায়ের করণীয়
নবজাতকের জন্ডিস একটি সাধারণ সমস্যা হলেও, মা-বাবার জন্য এটি কিছুটা উদ্বেগজনক হতে পারে। যদিও এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, তবে এটি সঠিকভাবে মোকাবেলা করা গুরুত্বপূর্ণ।
শিশুর ত্বক ও চোখের সাদা অংশের রঙ পরিবর্তন হলে, অর্থাৎ যদি তা হলুদ হয়ে যায়, তাহলে এটি জন্ডিসের প্রথম লক্ষণ হতে পারে। নবজাতককে পর্যাপ্ত দুধ খাওয়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দুধ খেলে শরীর থেকে বিলিরুবিন দ্রুত বের হয়ে যায়, যা জন্ডিসের সৃষ্টি করতে পারে।
নিয়মিতভাবে শিশুদের খাওয়ানো এবং তাদের সুস্থ রাখা মায়ের দায়িত্ব। যদি মা দুধ পান করান, তবে সেক্ষেত্রে মায়ের দুধের মাধ্যমে শিশুর শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি পৌঁছায় এবং তা জন্ডিসের লক্ষণ কমাতে সহায়ক হতে পারে।
নবজাতকের সুস্থতা ফিরিয়ে আনার জন্য বিশেষ যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। যেমন, সূর্যালোকের মধ্যে কিছু সময়ের জন্য শিশুকে রাখা যেতে পারে, তবে অত্যধিক রোদে না রেখে, বিশেষভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এটি করা উচিত।
এর মাধ্যমে শিশুর শরীরের বিলিরুবিনের পরিমাণ কমে যেতে পারে। তবে, যদি জন্ডিস দীর্ঘস্থায়ী হয় বা লক্ষণগুলো আরও তীব্র হয়ে যায়, তখন চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত, যদি শিশুর ত্বক আরও হলুদ হয়ে যায় বা শিশুর মধ্যে অন্যান্য সমস্যা দেখা দেয়, তখন চিকিৎসক ফটোথেরাপি বা অন্য কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারেন।
এছাড়া, জন্ডিসের অন্যান্য কারণগুলিও হতে পারে, যেমন রক্তের গ্রুপের অমিল বা শরীরে কোনো সংক্রমণ। এই ধরনের পরিস্থিতিতে মা-বাবাকে আরো সতর্ক থাকতে হবে এবং শিশুর চিকিৎসা সংক্রান্ত সব পরামর্শ মেনে চলতে হবে।
অনেক সময় নবজাতকের শরীরে অতিরিক্ত বিলিরুবিন জমে যাওয়ার কারণে সঠিক চিকিৎসা প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে, চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এভাবে, নবজাতকের জন্ডিস নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও সঠিক যত্ন এবং সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে শিশুর সুস্থতা নিশ্চিত করা সম্ভব। মা-বাবাকে সচেতন হতে হবে এবং নবজাতকের প্রতি যত্নশীল মনোভাব রাখতে হবে, যাতে তারা দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে।
নবজাতকের জন্ডিসের স্বাভাবিক মাত্রা কত
নবজাতকের জন্ডিসের স্বাভাবিক মাত্রা সাধারণত বিলিরুবিনের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে। নবজাতকরা জন্মের প্রথম কয়েক দিনে যেহেতু তাদের লিভার সম্পূর্ণভাবে কার্যক্ষম হয়ে ওঠে না, তাই তাদের রক্তে বিলিরুবিনের পরিমাণ কিছুটা বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে, এটি স্বাভাবিক এবং কিছুদিনের মধ্যে সেরে যায়।
নবজাতকের রক্তে বিলিরুবিনের স্বাভাবিক মাত্রা সাধারণত:
সময়কাল | স্বাভাবিক বিলিরুবিন স্তর (mg/dL) | ব্যাখ্যা |
প্রথম ২৪ ঘণ্টা | ৬ mg/dL এর কম | জন্মের প্রথম ২৪ ঘণ্টায় নবজাতকের বিলিরুবিন স্তর সাধারণত বৃদ্ধি পায় না। তবে, ৬ mg/dL এর বেশি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন। |
৪৮-৭২ ঘণ্টা | ৫-১২ mg/dL | এই সময়ে বিলিরুবিনের কিছু বৃদ্ধি স্বাভাবিক। তবে, ১২ mg/dL এর বেশি হলে চিকিৎসক দেখানো উচিত। |
৪-৭ দিন | ১২ mg/dL পর্যন্ত | এই সময়ে কিছু বৃদ্ধি স্বাভাবিক, তবে ১২ mg/dL এর বেশি হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। |
৭ দিন পর | ১২ mg/dL এর বেশি | ৭ দিন পর বিলিরুবিনের স্তর ১২ mg/dL এর বেশি হলে তা গুরুতর অবস্থা হতে পারে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। |
২০ mg/dL এর বেশি | ২০ mg/dL বা তার বেশি | ২০ mg/dL এর বেশি হলে এটি একটি অতি গুরুতর অবস্থা, দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ আবশ্যক। |
যদি নবজাতকের বিলিরুবিনের পরিমাণ 20 মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার (mg/dL) বা তার বেশি হয়ে যায়, তাহলে এটি হুমকির কারণ হতে পারে এবং চিকিৎসা প্রয়োজন। এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত চিকিৎসককে দেখানো উচিত।
নবজাতকের বিলিরুবিন কমানোর উপায়
নবজাতকের বিলিরুবিন কমানো গুরুত্বপূর্ণ, কারণ যদি বিলিরুবিনের স্তর অত্যধিক বৃদ্ধি পায়, তাহলে তা নবজাতকের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, বিশেষ করে মস্তিষ্কের ক্ষতি করতে পারে।
তবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিলিরুবিনের স্তর স্বাভাবিকভাবে কমে আসে এবং চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী কিছু উপায় অবলম্বন করলে এটি দ্রুত স্বাভাবিক হতে পারে। নিচে নবজাতকের বিলিরুবিন কমানোর কিছু উপায় তুলে ধরা হলো:
- নিয়মিত দুধ খাওয়ানো
বিলিরুবিন কমানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো নবজাতককে নিয়মিত দুধ খাওয়ানো। এটি শিশুর শরীর থেকে বিলিরুবিন বের করার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। মায়ের দুধ বা ফর্মুলা মিল্ক নিয়মিত খাওয়ানো নিশ্চিত করলে বিলিরুবিনের মাত্রা দ্রুত কমে আসে।
দুধ খাওয়ানোর মাধ্যমে শিশুর হজম প্রক্রিয়া সক্রিয় থাকে এবং তার শরীর বিলিরুবিন নিষ্কাশন করতে সক্ষম হয়।
- ফটোথেরাপি (নীল আলো থেরাপি)
ফটোথেরাপি হলো এক ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে নবজাতককে বিশেষ ধরনের নীল আলোতে রাখা হয়। এই আলোর সাহায্যে বিলিরুবিন শরীর থেকে দ্রুত বের হয়ে যায়। যদি শিশুর বিলিরুবিনের স্তর খুব বেশি থাকে, তবে চিকিৎসকরা ফটোথেরাপি ব্যবহার করেন। এটি একটি নিরাপদ এবং কার্যকর পদ্ধতি যা অনেক নবজাতকের জন্য প্রয়োজনীয় হতে পারে।
- শিশুকে সূর্যের আলোতে রাখা
যদি নবজাতকের অবস্থান ফটোথেরাপির জন্য উপযুক্ত না হয়, তবে সৌর আলোর সংস্পর্শ শিশুকে সহায়ক হতে পারে। তবে, এটি অবশ্যই সতর্কতার সাথে করা উচিত, কারণ অতিরিক্ত সূর্যের আলো শিশুদের ত্বকের ক্ষতি করতে পারে। মাত্র ১৫-২০ মিনিটের জন্য সূর্যের আলোতে রাখা শিশুর জন্য উপকারী হতে পারে, তবে এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।
- বিশ্রাম এবং পর্যাপ্ত জল খাওয়ানো
নবজাতককে যথাযথ বিশ্রাম এবং পর্যাপ্ত জল খাওয়ানো তার শরীরের উন্নত পুনঃস্থাপন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে, যা বিলিরুবিন কমাতে সাহায্য করে। তবে, ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে পানির পরিমাণ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হতে হবে।
- বিশেষ চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা
কিছু ক্ষেত্রে, বিলিরুবিন স্তরের অতিরিক্ত বৃদ্ধি মানে এটি একটি গুরুতর সমস্যা। চিকিৎসক যদি মনে করেন, তারা বিশেষ চিকিৎসা যেমন রক্ত পরিস্রাবণ (exchange transfusion) প্রস্তাব করতে পারেন। এটি একটি পদ্ধতি যেখানে শিশুর রক্তের অতিরিক্ত বিলিরুবিন অপসারণ করা হয়। তবে, এটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী করা উচিত।
- সতর্কভাবে শিশুর স্বাস্থ্যের পর্যবেক্ষণ
নবজাতকের বিলিরুবিন কমানোর প্রক্রিয়া চলাকালীন, শিশুর স্বাস্থ্য নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা উচিত। বিলিরুবিনের স্তর স্বাভাবিক হওয়ার জন্য যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ, যাতে শিশুর কোনো বড় ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা না হয়।
- চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা
নবজাতকের বিলিরুবিন কমানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা। চিকিৎসক বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে শিশুর স্বাস্থ্য এবং বিলিরুবিনের স্তরের অবস্থা মূল্যায়ন করে, এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণ করেন।
নবজাতকের বিলিরুবিনের মাত্রা কমানোর জন্য এই উপায়গুলো কার্যকর হতে পারে, তবে সবসময় চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা এবং সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নবজাতকের চোখ হলুদ হলে করণীয়
নবজাতকের চোখে হলুদভাব দেখা দিলে এটি সাধারণত জন্ডিসের একটি লক্ষণ হতে পারে, যা নবজাতকদের মধ্যে একটি সাধারণ অবস্থা। যখন শিশুর শরীরে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায়, তখন তা ত্বক এবং চোখের সাদা অংশে হলুদ ভাব সৃষ্টি করে।
যদিও এটি অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক এবং কিছু দিনের মধ্যে সেরে যায়, তবে শিশুর চোখে হলুদভাব দেখা দিলে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। প্রথমেই শিশুর বিলিরুবিন স্তরের পরীক্ষা করানো গুরুত্বপূর্ণ।
যদি বিলিরুবিনের মাত্রা বেশি হয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
নবজাতকের শরীর থেকে বিলিরুবিন বের করার জন্য তাকে নিয়মিত দুধ খাওয়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মায়ের দুধ বা ফর্মুলা মিল্ক শিশুর জন্য উপকারী, কারণ এটি তার শরীর থেকে অতিরিক্ত বিলিরুবিন বের করে দেয়।
দুধ খাওয়ানোর পাশাপাশি, শিশুর তাপমাত্রাও পরীক্ষা করা উচিত, কারণ জন্ডিসের প্রভাবের কারণে শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে পারে।
এছাড়া, চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ চিকিৎসা যেমন ফটোথেরাপি (নীল আলো থেরাপি) প্রয়োজন হতে পারে। যদি নবজাতকের জন্ডিস কিছু দিনের মধ্যে না কমে বা বিলিরুবিন স্তরের পরিমাণ বিপদজনক পর্যায়ে পৌঁছায়, তবে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
অবশ্যই মনে রাখা জরুরি যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জন্ডিস স্বাভাবিক এবং কিছুদিনের মধ্যে সেরে যায়। তবে, একে উপেক্ষা করা ঠিক নয়। শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ করা নিরাপদ এবং প্রয়োজনীয়।
আরো পড়ুন : নবজাতকের পেট ফাঁপা দূর করার ঘরোয়া উপায় বিস্তারিত জানুন
আরো পড়ুন : শিশুর নিউমোনিয়া রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার
আরো পড়ুন : গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কত থাকা ভালো? কমে গেলে করণীয়!
আরো পড়ুন : সিজারের পর ব্যথা কতদিন থাকে? হলে করণীয় কি
আমাদের কথা:
নবজাতকের জন্ডিসের সমস্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া খুবই সাধারণ, কিন্তু সঠিক তথ্য ও সচেতনতা থাকা মায়েদের জন্য অনেক সহায়ক হতে পারে। নবজাতক শিশুর যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে সঠিক পদক্ষেপ নেয়া মায়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যখন এটি জন্ডিসের মতো সাধারণ, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতির সাথে সম্পর্কিত।
জন্ডিস সাধারণত সাময়িক এবং চিকিৎসায় ভালো হয়, কিন্তু যখন মায়েরা সচেতন থাকেন এবং নির্দেশনা মেনে চলেন, তখন শিশুর সুস্থতা দ্রুত ফিরে আসে।
শিশুর লিভারের উন্নতি হওয়ার সাথে সাথে বিলিরুবিনের পরিমাণও স্বাভাবিক হয়ে ওঠে, তবে এক্ষেত্রে মা-বাবার যত্ন এবং অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। সঠিক খাবার খাওয়ানো, শিশুকে পর্যাপ্ত সময় সূর্যালোকের মধ্যে রাখা এবং প্রাথমিক লক্ষণগুলির দিকে মনোযোগ রাখা শিশুর সুস্থতার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আপনি যদি আপনার নবজাতকের জন্ডিস নিয়ে আরও কোন প্রশ্ন বা চিন্তা অনুভব করেন, তাহলে সতর্কভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং তার দেওয়া নির্দেশনা অনুসরণ করুন। মায়ের যত্ন, ধৈর্য এবং সচেতনতা শিশুর সুস্থতার প্রথম পদক্ষেপ।
FAQ:
- নবজাতকের জন্ডিস হলে কি কি সমস্যা হয়নবজাতকের জন্ডিস হলে ত্বক ও চোখের সাদা অংশে হলদেটে রং দেখা যায়, আর কিছু ক্ষেত্রে ঘুম ঘুম ভাব, খাওয়ার অস্বীকৃতি, বা আচরণে পরিবর্তনও দেখা যেতে পারে। এটি যদি না ঠিক হয়, তবে মস্তিষ্কের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
- নবজাতকের বিলিরুবিন কত হলে ফটোথেরাপি দিতে হয়?নবজাতকের রক্তে বিলিরুবিন ১৫ মাইক্রোগ্রাম/ডিএল এর বেশি হলে ফটোথেরাপি প্রয়োজন হতে পারে, তবে এটি শিশুর বয়স, অবস্থান এবং চিকিৎসকের পরামর্শের উপর নির্ভর করে।
- নবজাতকের জন্ডিস হলে পায়খানার রং কেমন হয়?নবজাতকের জন্ডিস হলে পায়খানার রং সাদাটে বা হলুদ হতে পারে। এটি কখনও কখনও বাদামি বা সোনালী হতে পারে, তবে পায়খানার রং পরিবর্তিত হওয়া স্বাভাবিক।
- জন্ডিসের কত পয়েন্ট?
জন্ডিসের পর্যায় নির্ধারণ করতে বিলিরুবিনের মাত্রা পরিমাপ করা হয়। ৫ মাইক্রোগ্রাম/ডিএল থেকে ১০ মাইক্রোগ্রাম/ডিএল পর্যন্ত হলুদতা হতে পারে এবং ১৫ মাইক্রোগ্রাম/ডিএল বা তার বেশি হলে চিকিৎসা প্রয়োজন।
- নবজাতকের দ্রুত বিলিরুবিন কমানোর উপায়?ফটোথেরাপি, সঠিক দুধ খাওয়ানো এবং ডাক্তারি পরামর্শ গ্রহণ করে নবজাতকের বিলিরুবিন দ্রুত কমানো সম্ভব।
- জন্ডিস হলে দুধ খাওয়া যাবে কি?জন্ডিস হলে দুধ খাওয়াতে কোনো সমস্যা নেই। প্রাথমিক দুধ (কলাস্ট্রাম) শিশুর পেট পরিষ্কার করতে সাহায্য করে এবং তার পুষ্টি যোগায়।
- বুকের দুধ খাওয়ালে কি জন্ডিস বাড়ে?
সাধারণত বুকের দুধ খাওয়ালে জন্ডিস বৃদ্ধি পায় না, তবে কিছু ক্ষেত্রে মাতার দুধে বিলিরুবিনের অতিরিক্ত পরিমাণ থাকার কারণে এটা বাড়তে পারে।
- নবজাতকের পায়খানা কেমন হওয়া উচিত?নবজাতকের পায়খানা সাধারণত সরল বা মোলায়েম থাকে, রঙ সাধারণত হলুদ বা সোনালি হয় এবং পায়খানার পরিমাণ ছোট ছোট হতে পারে।
- শিশুর জন্ডিস হলে মায়ের কি খাওয়া যাবে না?
মা যদি জন্ডিস আক্রান্ত হন, তবে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, এবং অতিরিক্ত চর্বি বা মিষ্টি খাবার থেকে বিরত থাকা উচিত। তবে এটি শিশুর জন্ডিসের সাথে সম্পর্কিত নয়, এবং শিশুর জন্য দুধ খাওয়াতে সমস্যা হবে না।
4 thoughts on “নবজাতকের জন্ডিস হলে মায়ের করনীয়”