আমাদের শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর মধ্যে কিডনি অন্যতম। এটি রক্ত পরিশোধন, শরীরের পানি ও খনিজের ভারসাম্য রক্ষা এবং বর্জ্য পদার্থ অপসারণের মতো অত্যাবশ্যকীয় কাজগুলো করে। কিন্তু আধুনিক জীবনের অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস ও কিছু স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে অনেকেই কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। কিডনি রোগের কারণ সম্পর্কে সঠিক সময়ে সচেতন না হলে এটি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।
আজ আমরা কিডনি রোগের কারণ, এর সাধারণ লক্ষণ এবং রোগ প্রতিরোধের কার্যকরী উপায়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
কিডনি রোগের কারণ: কেন ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের কিডনি?

কিডনি রোগ বিভিন্ন কারণে হতে পারে। এর মধ্যে কিছু প্রধান কারণ নিচে আলোচনা করা হলো:
১. ডায়াবেটিস (Diabetes Mellitus)
ডায়াবেটিস হলো কিডনি রোগের এক নম্বর কারণ। রক্তে শর্করার মাত্রা দীর্ঘ সময় ধরে বেশি থাকলে তা কিডনির সূক্ষ্ম রক্তনালীগুলোকে ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই অবস্থাকে ‘ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি’ বলা হয়। সঠিক খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও ঔষধের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখলে কিডনি বিকলের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।
২. উচ্চ রক্তচাপ (High Blood Pressure)
উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন কিডনির দ্বিতীয় প্রধান শত্রু। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ কিডনির ভেতরের রক্তনালীগুলিতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, যার ফলে সময়ের সাথে সাথে কিডনির কার্যক্ষমতা কমতে থাকে। শুধু তাই নয়, কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হলে রক্তচাপ আরও বেড়ে যায়, যা একটি দুষ্ট চক্র তৈরি করে।
৩. গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস (Glomerulonephritis)
এটি এমন একটি রোগ যেখানে কিডনির ছাঁকনি বা ফিল্টার ইউনিট (গ্লোমেরুলাই) গুলো ফুলে যায় বা প্রদাহ সৃষ্টি হয়। এটি তীব্র বা দীর্ঘস্থায়ী উভয়ই হতে পারে এবং এর কারণে কিডনি তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারায়।
৪. মূত্রনালীর দীর্ঘস্থায়ী প্রতিবন্ধকতা (Chronic Urinary Tract Obstruction)
কিডনিতে পাথর, প্রস্টেট গ্রন্থির বৃদ্ধি বা মূত্রনালীর জন্মগত ত্রুটির কারণে যদি দীর্ঘ সময় ধরে প্রস্রাবের প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়, তবে এটি কিডনির ওপর চাপ ফেলে এবং এর স্থায়ী ক্ষতি করতে পারে।
৫. অন্যান্য কারণ
- ব্যথানাশক ওষুধের অপব্যবহার: দীর্ঘ সময় ধরে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া অতিরিক্ত পরিমাণে ব্যথানাশক (NSAIDs) ওষুধ সেবন করলে কিডনির ক্ষতি হতে পারে।
- বংশগত কারণ: কিছু কিডনি রোগ, যেমন পলিসিস্টিক কিডনি ডিজিজ (PKD), বংশগত কারণে হয়ে থাকে।
- অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ: খাদ্যে অতিরিক্ত লবণ কিডনির ওপর চাপ বাড়ায় এবং উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি তৈরি করে।
- শরীরে পানির অভাব: পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান না করলে কিডনিতে পাথর হওয়ার এবং এর কার্যক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার ঝুঁকি থাকে।
কিডনি রোগের লক্ষণ: কখন সতর্ক হবেন?
কিডনি রোগের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এর ৭০-৮০ ভাগ কার্যক্ষমতা নষ্ট হওয়ার আগে তেমন কোনো গুরুতর লক্ষণ প্রকাশ পায় না। তবে কিছু প্রাথমিক লক্ষণ রয়েছে, যা দেখলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
প্রাথমিক ও গুরুতর লক্ষণসমূহ:
| লক্ষণের বিভাগ | বিস্তারিত বর্ণনা |
| প্রস্রাবের পরিবর্তন | ঘন ঘন বা কম প্রস্রাব হওয়া: বিশেষ করে রাতে বারবার প্রস্রাব হওয়া। প্রস্রাবে ফেনা: প্রস্রাবে অতিরিক্ত প্রোটিন যাওয়ার কারণে ফেনা তৈরি হওয়া। প্রস্রাবে রক্ত: প্রস্রাবের রং লালচে বা গোলাপি হওয়া। |
| ফোলাভাব (Edema) | হাত-পা ও মুখমণ্ডলে ফোলা: কিডনি শরীর থেকে অতিরিক্ত লবণ ও পানি বের করতে না পারলে চোখ, মুখ, হাত-পা ও গোড়ালিতে জল জমে ফুলে যায়। |
| ক্লান্তি ও দুর্বলতা | কোনো কারণ ছাড়াই তীব্র ক্লান্তি ও দুর্বলতা অনুভব করা, কাজে মনোযোগ কমে যাওয়া, রক্তশূন্যতা (Anemia) সৃষ্টি হওয়া। |
| বমি বমি ভাব ও অরুচি | রক্তে বর্জ্য পদার্থ (Toxins) জমা হওয়ার কারণে খাবারে অরুচি, বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া। |
| অন্যান্য লক্ষণ | উচ্চ রক্তচাপ: হঠাৎ করে উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেওয়া বা বিদ্যমান রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না আসা। মাংসপেশিতে টান: শরীরে খনিজের (যেমন ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম) ভারসাম্যহীনতার কারণে মাংসপেশিতে ঘন ঘন টান লাগা। শুষ্ক ও চুলকানিযুক্ত ত্বক: রক্তে টক্সিন জমা হওয়ার কারণে ত্বক শুষ্ক ও চুলকানিযুক্ত হতে পারে। |
কিডনি রোগের প্রতিকার ও প্রতিরোধে করণীয়

কিডনি রোগের প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। সচেতনতা ও জীবনযাত্রার পরিবর্তন এনে এই মারাত্মক রোগটি থেকে দূরে থাকা সম্ভব।
১. স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন:
- ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ: রক্তের শর্করা (Sugar) নিয়মিত পরীক্ষা করা এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণে রাখা।
- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ: উচ্চ রক্তচাপকে কখনোই অবহেলা করবেন না। নিয়মিত ঔষধ সেবন এবং খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনা আবশ্যক।
- স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ: তাজা ফল ও সবজি বেশি খান। উচ্চ লবণ, চিনি ও প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন।
- পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান: প্রতিদিন কমপক্ষে ৮-১০ গ্লাস বা পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন। তবে যদি আপনার কিডনি রোগ ইতোমধ্যে ধরা পড়ে থাকে, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী পানি পান করুন।
- ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ: ধূমপান ও মদ্যপান কিডনি এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি করে।
২. ঔষধ গ্রহণে সতর্কতা:
- ব্যথানাশক ওষুধ: ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে বা ঘন ঘন ব্যথানাশক ওষুধ (NSAIDs) সেবন করা থেকে বিরত থাকুন।
- ঔষধের ডোজ: যেকোনো নতুন ঔষধ শুরু করার আগে আপনার যদি কিডনি রোগ থাকে, তাহলে অবশ্যই ডাক্তারকে জানান।
৩. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা:
যদি আপনার ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা কিডনি রোগের পারিবারিক ইতিহাস থাকে, তাহলে বছরে একবার রক্তে ক্রিয়েটিনিন (Creatinine) এবং প্রস্রাবে অ্যালবুমিন (Albumin) পরীক্ষা করান। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে কিডনি রোগ নিরাময় বা এর গতি ধীর করা সম্ভব।
আরো পড়ুন : বাচ্চাদের মাথা ঘামার কারণ বিস্তারিত জানুন
আরো পড়ুন : গর্ভাবস্থায় ব্যায়ামের উপকারিতা এবং সঠিক পদ্ধতি
আরো পড়ুন : নবজাতকের টিকা : নবজাতকের টিকার তালিকা
আরো পড়ুন : নবজাতকের নাভি শুকানোর উপায়
আমাদের কথা
Mom & Kiddy প্ল্যাটফর্মে আপনাকে স্বাগত। কিডনি আমাদের শরীরের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কিডনি রোগের মতো জটিল স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো নিয়ে সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য বাংলায় সহজভাবে পৌঁছে দেওয়াই আমাদের লক্ষ্য। আমরা বিশ্বাস করি, কিডনি রোগের কারণ এবং এর লক্ষণ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকলে রোগ প্রতিরোধ করা অনেক সহজ হয়। এই ব্লগে আমরা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এবং নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই করে আপনাদের সামনে তুলে ধরি যাতে আপনি আপনার নিজের ও আপনার পরিবারের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আপনার সুস্থতাই আমাদের অঙ্গীকার।